অভিমানী ছোট বোন
গল্প টি ১০ বছরের এক ভাই এর......তারই কথা এগুলো...
আমার না আজ অনেক মন খারাপ।
--মন খারাপ কেন?!
--আমার না কোন ছোট ভাই নেই।
--আচ্ছা ছোট ভাই-বোন না থাকা কি খুব
দুঃখের?
--হ্যাঁ,অনেক দুঃখের......
--দুঃখের কেন হবে?ভেবে দেখো ছোট ভাই-বোন থাকলে তারা তোমার খাবারে ভাগ বসাতো, অকারনে মায়ের কাছে নালিশ করে মার খাওয়াতো,রাত বিরাতে চকলেট এনে দিতে বলত, তোমার আম্মুও তোমাকে আর
আগের মত আদর করতো না......
বল,এসব হলে কি তোমার ভাল লাগতো?
(কিছুক্ষণের জন্য চিন্তায় পড়ে গেলাম......
ছোট ভাই থাকলে কি তাহলে এতোটাই খারাপ
অবস্থা হবে?কই সৌরভ ভাইয়াকে তো কখনো দুঃখ করতে দেখিনি,মাঝে মাঝে যখন ভাইয়াদের বাড়ি যেতাম তখন দেখতাম উনি আর ওনার
ছোট ভাই কত মজা করে ক্রিকেট খেলছে।
ছোট ভাই-বোন থাকলে দুজন মিলে গেম খেলা যায়,রাত বিরাতে লুকোচুরি খেলা যায়,কারো সাথে ঝগড়া হলে দুজন মিলে পিটানো যায়। নাহ ছোট ভাই থাকা মনে হয় না এত খারাপ হবে......)
"কিরে?!! একা একা কার সাথে কথা বলিস!!
খেতে আয়......",আম্মু র ডাকে হুঁশ ফিরলো।
মাঝে মাঝেই আমি নিজের
সাথে নিজে আলোচনা করি।আলোচনার
কথাগুলো ঘুরে ফিরে এখানে এসেই থেমে যায়।
রাত ১০ টা,আম্মু আমার বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছে।
--আম্মু?
--বল
--আমার না একটা ভাইয়ের খুব শখ...
-ভাই?বোন না কেন?
--বোনের সাথে তো ক্রিকেট খেলতে পারবো না।
--আচ্ছা ঠিক আছে,এখন ঘুমা।
মাসখানেক পরঃ
খেলাধুলা শেষ করে বাসায় ফিরলাম,সবাই
দেখি কিছু একটা নিয়ে খুব খুশি হয়ে আছে,দাদীর কাছে জানতে পারলাম আম্মুর বাবু হবে।ভাই না বোন হবে এখন জানা সম্ভব না,কিন্তু
আমি সব্বার কাছে বলে বেড়ালাম," ওই জানিস,
আমার না ভাই হবে।" নিজের খেলনাগুলো তো সব আগেই নষ্ট করে ফেলেছি,এখন ভাইকে কি দিবো,ভাই এর নাম কি হবে এসব ভাবতে ভাবতেই দিন চলে যাচ্ছিলো।
আম্মুর আল্ট্রাসনোগ্রাফ করা হয়েছে,জানতে পারলাম ভাই না,একটা বোন পেতে যাচ্ছি আমি।প্রথমে খুব মন খারাপ হল,পরে যখন দুষ্টুমিতে মেতে থাকা একটা ছোট্ট বোনের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠলো,তখন আর মনে কোন কষ্ট থাকলো না।নতুন উদ্দমে আবার সব পরিকল্পনা করতে থাকলাম।একবার বাজারে গিয়ে একটা ব্যাট পছন্দ করেছিলাম।
টিফিনে র টাকাগুলো জমিয়ে একটা মাটির
ব্যাঙ্কে জমা করে রাখছিলাম ব্যাট টা কেনার
জন্য।কিন্তু আজ ব্যাঙ্কটা ভেঙে ফেললাম, টাকাগুলো দিয়ে নৌরিন এর জন্য পুতুল কিনবো,আমার বোনটা নাহলে খেলবে কি দিয়ে?ও বলতে ভুলে গেছি আমার যে ছোট্ট বোন আসছে তার নাম আমিই দিয়েছি,নৌরিন।
আম্মুকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে ৩ দিন
আগে। আজ আমরা হসপিটালে যাচ্ছি,আম্মুর
সাথে দেখা করতে।ডাক্তারগুলো খুব পচা,বলে কি ১২ বছরের নিচে কাউকে ঢুকতে দিবেনা।আমি এতো বললাম যে আর দুই বছর পর ই আমার বয়স ১২ হবে,তবুও আমাকে ঢুকতে দিলোনা।খুব কান্না পাচ্ছিলো,কিন্তু না আমি কাঁদবোনা।
ডাক্তা র বলেছে এখন নাকি আম্মুকে কোন কষ্ট
দেওয়া যাবেনা,তাহলে নৌরিন কষ্ট পাবে।
আর বড়জোর দুই-তিন দিন,তার মধ্যেই আমার বোনটি এসে যাবে বাসায়।অনেক ভালো লাগছে ভাবলেই,বাসায় কেমন জানি ঈদ ঈদ ভাব।
কিন্তু হটাত নজরে আসলো আব্বুকে আজ খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে,দাদীর সাথে অনেকক্ষন ধরে কি নিয়ে যেন আলোচনা করলো,তারপর মটরসাইকেল বের করে কোথায় যেন চলে গেলো।আমি কয়েকবার দাদীর কাছে জানতে চাইলাম,কিন্তু দাদী কিছুই বলতে চায় না।বললো ছোটদের এসব শুনতে নেই। কেন জানি কিছু ভালো লাগছেনা।
অনেক জোরাজুরি তে দাদী বললো আজ নাকি আব্বু আম্মু আর বোন টি কে নিয়ে আসবে।এটাতো অনেক খুশির সংবাদ,কিন্তু দাদী এমন
মনমরা হয়ে আছে কেন?আমি অবশ্য ওসব
বুঝতে গেলাম না।বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন আব্বু আসে।
প্রায় দুই ঘন্টা পর বাসার সামনে একটা সাদা মাইক্রোবাস এসে থামলো,আমি খুশিতে ছুটে গেলাম নিচে।পিছনের দরজা খুলে আব্বু
আর আম্মু বের হল।
আমি উঁকিঝুঁকি মেরে মাইক্রোর ভিতরটা দেখার
চেষ্টা করলাম,কিন্তু ভিতরে কোথাও বোনকে দেখলাম না।
আম্মুকে প্রশ্ন করলাম,"কই?আমার বোন কোথায়?? "
কি হল বুঝলাম না,আম্মু আমাকে কিছু না বলে
জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।হঠাত আব্বুর হাতে মাঝারি সাইজের একটা বাক্স,কি আছে ভিতরে?
সেটা খোলা মাত্রই দেখলাম আমার পরীর মত বোন টি ঘুমিয়ে আছে। একটু সস্তি পেলাম। কিন্তু কেউ তাকে ঘরে নিচ্ছে না কেন???
ঘন্টা খানেক পরে ছোট্ট একটা খাটিয়ায় আমার
বোনটাকে শুইয়ে রাখা হলো।কয়েকজনের
সাথে আব্বুও খাটিয়ার একপাশ কাঁধে তুলে নিয়ে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছে।
আমি ভাবতে থাকলাম..
কেউ নৌরিনের খেলনাগুলো নিলোনা কেন?আমার বোনটা একা একা কি করবে তাহলে?
অনেক আগেই সবাই চলে গেছে। আমিও ছোট চাচ্চুর সাথে বেশ কিছুক্ষণ পরে বোনের কাছে গেলাম।কিন্তু কবরস্থানে কেন?? এখানে তো সব মরা মানুষ থাকে। ঢোকার পথেই ডান পাশে ছোট্ট একটা কবর।চাচ্চু বলল এখানেই থাকবে তোর বোন।বলেই কেঁদে ফেলল....
আমার আর কিছু বোঝার বাকি রইল না।
এখন প্রায় ৩ বছর পেরিয়ে গেছে....
আগে থেকে অনেক কিছুই এখন বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। প্রতিদিন ই যাই বোন কে দেখতে..
আজও আমি আমার বোনের সাথে দেখা করতে আসছি...
কবর টার পাশে গিয়ে বসলাম....তারপর...
আমার উপর তোর অনেক অভিমান,তাইনা?বোন
না চেয়ে ভাই চেয়েছিলাম তাই রাগ করেছিস?এই
দ্যাখ তোর জন্য পুতুল কিনে এনেছি,খেলবিনা তুই? আর রাগ করে থাকিস না,বাসায় চল।তোর জন্য প্রতিদিন এত্তগুলো চকলেট এনে দেবো,আম্মু তোকে বেশি আদর করলেও রাগ করবোনা,তবুও ফিরে চল।"
প্রতিদিন অনেক আশা নিয়ে যাই,কিন্তু আমার
ছোট্ট বোনটা বড্ড অভিমানী, আমার চোখের পানি দেখেও এখনো রাজি হয়নি আমার সাথে ফিরে যেতে।আমি অবশ্য হাল ছাড়িনি, ছাড়বোও না কখনো............।
একদিন না একদিন তো অভিমান ভাঙবেই।
Comments
Post a Comment